logo
logo

ঢোপকল এর আত্মকথা : রাজশাহী

Blog single photo

রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য গুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ঢোপকলের সঙ্গে রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িত। মহারাণী হেমন্ত কুমারীর প্রচেষ্টা ও অনুদানে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজশাহী বাসীর জন্য সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানি সরবরাহ প্রকল্প মহারাণী হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস নির্মিত হয় যার অন্যতম নিদর্শন রাজশাহী শহরে অবস্থিত এই ঢোপকলসমূহ।

‘ঢোপ’ শব্দটি এসেছে হিন্দি ‘ধোপ’ থেকে, যার অর্থ ধোয়া বা ধোয়ানোর কাজ। আর ‘কল’ মানে কলস বা কলের জলধারা, অর্থাৎ পানি দেওয়ার যন্ত্র। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘ঢোপ কল’ বলতে বোঝায় এক ধরনের পাবলিক পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, যা সাধারণত হাত ঘুরিয়ে বা চেপে পানি বের করার জন্য ব্যবহৃত হতো।

রাজশাহীকে আমরা চিনি তার মসৃণ রেশম, লাল-সবুজ আমের রাজ্য, আর পদ্মা, মহানন্দার শান্ত/অশান্ত স্বরে। কিন্তু রাজশাহীর এই পরিচিতির আড়ালেও লুকিয়ে আছে কিছু হারিয়ে যাওয়া শব্দ, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। তেমনই একটি অনন্য সংস্কৃতির নাম “ঢোপ কল” – এক সময়কার শহরের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আজ যা কেবল স্মৃতি হয়ে আছে প্রবীণদের মনে।

এই ঢোপকল তৈরীর সময়ে রাজশাহী পৌরসভার (বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত। সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ঘটেছিল তখন। যার ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা-আমাশয় সহ নানারকম পেটের পীড়া। বেশ কিছু লোকের মৃত্যুও ঘটেছিল সেই সময় এই অসুখের জন্য।

রায় ডিএন দাশগুপ্ত রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৯৩৪-৩৯) থাকাকালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির কল স্থাপন করা হবে। ১৯৩৭ সালের অগাষ্ট মাসের কোন একটি দিনে মিনিষ্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এবং ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকা। এই কাজে নগরীর নামকরা ধনী লোকেদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্র ধরেই মহারাণী হেমন্তকুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর নামেই ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপিত হয়। কালক্রমে তার নাম হেমন্তকুমারী ঢোপকল নামেই পরিচিত হতে থাকে

ব্রিটিশ আমলে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন মোড়ে, পাড়া-মহল্লায় বসানো হয়েছিল ঢোপ কল। তখনকার দিনে শহরে আধুনিক নলকূপ বা পানির লাইন সবার ঘরে পৌঁছায়নি। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী, ঘোড়ারগাড়ি চালক, পথচারীরা এই ঢোপ কল থেকে পানি সংগ্রহ করত। অনেকে এটিকে গোসলের জন্য, আবার অনেকে পারিবারিক নানা কাজে ব্যবহার করত।

ঢোপ কলের পাশে ছোট ছোট পাকা চাতাল বা মাচাও থাকত, যেখানে মানুষ বসে বিশ্রাম নিত, গল্প করত। অনেক সময় ঢোপ কল হয়ে উঠত পাড়া-মহল্লার এক সামাজিক মিলনস্থল।

ঢোপ কল কেবল পানি সংগ্রহের কেন্দ্রই ছিল না, এটি ছিল এক সামাজিক সংযোগস্থল। এখানে শিশুরা খেলা করত, বৃদ্ধরা বিশ্রাম নিত, আর মহিলারা একসাথে পানি তুলতে এসে পারিবারিক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গল্প করত। অনেক বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, এমনকি বিবাদও জন্ম নিত এই ঢোপ কলের আশেপাশে।

১৯৮০ ও ৯০ দশকে শহরের পানি সরবরাহব্যবস্থার আধুনিকায়নের ফলে ঢোপ কল ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। অনেক কল অকেজো হয়ে পড়ে, অনেক জায়গায় সেগুলো তুলে ফেলা হয়। নবীন প্রজন্মের কাছে ‘ঢোপ কল’ শব্দটাই এখন অচেনা, অজানা।

যদিও ঢোপ কল এখন আর ব্যবহৃত হয় না, তবুও এটি রাজশাহীর লোকজ ইতিহাস ও নগর সংস্কৃতির এক মূল্যবান অংশ। রাজশাহীর ঢোপ কল যেন এক হারিয়ে যাওয়া সুর, যেটি এখনো প্রবীণদের মনে বাজে। এটি কেবল একটি পানির কল নয়, ছিল একটি জীবনযাপন, একটি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। Copy FM Shakhawat Hossain.

আপনার মতামত লিখুন

logo
Top